নিজস্ব প্রতিবেদক
মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে রাতের আঁধারে মাজার তৈরির চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে বিক্ষোভ করে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, চারদিকে দেয়াল দেওয়া খালি জায়গায় তিন দিন আগে কবর খুঁড়ে গায়েবি মাজার তৈরি করছিলেন শিফাত খন্দকার নামের পশ্চিম কাজির পাগলা গ্রামের এক ব্যক্তি। শিফাত সাত মাস আগে কবরস্থ বাবার লাশ রাতের আঁধারে কবর থেকে গোপনে তুলে আনার চেষ্টা করে। বিষয়টি এলাকাবাসী জেনে গেলে তাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা গতকাল মঙ্গলবার সকালে ওই বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, পশ্চিম কাজির পাগলা গ্রামের শিফাত খন্দকার নামে এক ব্যক্তি চায়না প্রজেক্টের এক খন্ড জমি কিনে সেখানে বাড়ি নির্মাণের জন্য মাটি ভরাট করেন। কোনো স্থাপনা না তুললেও বাড়ির চারদিকে বাউন্ডারি দেয়াল দেওয়া হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে রাতে সেখানে কিছু নারীর আনাগোনা বেড়ে যায়। এ নিয়ে এলাকাবসীর তেমন কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু দুইদিন আগে পাশের মাঠে ছেলেদের ক্রিকেট খেলার একটি বল বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরে চলে যায়। বলটি আনতে গিয়ে ছেলেরা সেখানে বাড়ির মাঝখানে একটি কবর খোঁড়া দেখতে পায়। বিষয়টি এলাকাবাসীকে জানালে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। পরে জানা যায়, শিফাত সেখানে তার বাবার কবর দিয়ে মাজার তৈরির চেষ্টা করছেন। সাত মাস আগে তার বাবা রাজা মিয়া মারা গেছেন। তাকে পদ্মা সেতুর কাছে মাওয়া চৌরাস্তা সংলগ্ন কুমারভোগ কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সেখান থেকে গোপনে বাবার লাশ তুলে এখানে এনে মাজার তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছিল। এতে স্থানীয় এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিনা আক্তার বলেন, রাতের আঁধারে গোপনে কেন মাজার তৈরি করতে হবে? সাত মাস পূর্বে যে ব্যক্তিকে কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তার লাশ কবর থেকে তুলে এনে এখানে মাজার করতে হবে কেন? মাজার নিয়ে আমার খুব খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। মৃত রাজা খন্দকারের ভাই দেলোয়ার ওরফে দেলা পাগলার মাজার ছিল মাওয়া পুরনো ফেরিঘাট এলাকায়। সেটি এখন নদীগর্ভে বিলীন। কয়েক বছর আগে আমি মাজারটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে কোনো ভালো পরিবেশ পাইনি। মাজার ঘিরে ছিল শুধুই গাঁজার আসর। আজ এখানে রাতের আঁধারে মাজার তৈরির চেষ্টা চলছে। আমাদের এই আবাসিক এলাকার পাশে আমরা এমন কোনো পরিবেশ চাই না, যা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খারাপ পথে চলে যায়। গাঁজার নেশায় নষ্ট হয়ে যাক আমাদের সন্তানরা- এমনটি কখনো কাম্য নয়।
স্থানীয় বাসিন্দা বাবু (৩২) বলেন, উনি এখানে বাড়ি করুক, ঘর তুলুক, অন্য যেকোনো কিছু করুক- তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু গোপনে মাজার তোলার যে চেষ্টা তিনি করে যাচ্ছেন, তা আমরা মেনে নেব না। কারণ এ ধরনের মাজার সমাজে ভালো কিছু দিতে পারে না। এখানে মাজার হলে গাঁজার আসর বসবে। আমাদের ছেলেরা সেখান থেকে মাদকাসক্ত হয়ে যেতে পারে। এরকম বিপদ জেনেও আমরা কোনোভাবেই এখানে মাজার হতে দিতে পারি না।
মুক্তা দেওয়ান (৪৫) বলেন, যেখানে মাজার তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে তার পাশেই আমার বাড়ি। আমরা চাই না এখানে মাজার হোক। কারণ এসব মাজার থেকে অনৈতিক কর্মকান্ড হয়ে থাকে। এখানে মাজার হলে আমার ছেলেমেয়েরাও মদ-গাঁজা খাওয়া ও জুয়া খেলা শিখবে। তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে।
কুমারভোগ কবরস্থান কমিটির সাধারণ সম্পাদক অভি কাজী জানান, সপ্তাহখানেক আগে রাজা খন্দকারের লাশ কবর থেকে তোলার জন্য এসেছিল পরিবারের কিছু লোক। কিন্তু আমরা তাদের বলে দিয়েছি ইউএনও, ডিসি অথবা পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে আসতে। সেসময় তারা চলে গেলেও গত রবিবার সন্ধ্যার দিকে তারা কবর থেকে রাজা মিয়ার লাশ তুলতে শুরু করেন। খবর পেয়ে কবরস্থানে গিয়ে তাদের কাছে লাশ তোলার প্রশাসনিক অনুমতি দেখতে চাই। কিন্তু তারা তা দেখাতে পারেননি। পরে পদ্মা সেতু উত্তর থানায় খবর দিই। ওসি (তদন্ত) ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। একপর্যায়ে অনুমতি না নিয়ে কবর খোঁড়া তাদের উচিত হয়নি বলে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান।
এ ব্যাপারে শিফাত খন্দকার জানিয়েছেন, কোনো প্রকার মাজার তোলা হবে না। আমার বাবার স্মৃতি সংরক্ষণ করতে কাজির পাগলায় আমাদের নতুন বাড়িতে বাবার কবরটি স্থানান্তর করতে চাচ্ছি। আমাদের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থান করতে চাচ্ছি। ভবিষ্যতে আমরা মারা গেলেও যেন আমাদের সেখানে দাফন করা হয়। প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে কবর খোঁড়া সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার বয়স মাত্র ২৩ বছর। বয়স কম হওয়াতে আমি বিষয়টি বুঝতে পারিনি। আমরা এ যুগের শিক্ষিত ছেলে। চাচা দেলু পাগলার মাজারের মতো কোনো কিছু করার ইচ্ছা আমাদের নেই।
পদ্মা সেতুর উত্তর থানার ওসি মো. আলমগীর হোসাইন জানিয়েছেন, মাজার তোলাকে কেন্দ্র করে কাজির পাগলায় এলাকাবাসী বিক্ষোভ করেছে। প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে কবর থেকে লাশ তুলে সেখানে মাজার করা যাবে না বলে আমরা জানিয়ে দিয়েছি। আপাতত সেখানে মাজার তৈরি করা বন্ধ রয়েছে। তবে তারা জেলা প্রশাসকের কাছে অনুমতির জন্য গিয়েছেন বলে জানতে পেরেছি। অনুমতি পেলে তারা লাশ স্থানান্তর করতে পারবেন।
এ ব্যাপারে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডাক্তার মো. আব্দুল আউয়াল জানান, উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিনা আক্তারের মাধ্যমে এলাকাবাসীর বিক্ষোভের বিষয়টি জানতে পারি। সেখানে মাজার হলে এলাকার পরিবেশ বিনষ্ট হতে পারে বলে তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তাছাড়া কবর স্থানান্তরের ব্যাপারেও কেউ যোগাযোগ করেননি। কবর স্থানান্তর করতে হলেও প্রশাসনিক কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে। কার কবর স্থানান্তর করতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কেও আমি অবগত নই। কোনো পক্ষ থেকেই কোনো লিখিত পাইনি। লিখিত অভিযোগ বা আবেদন পেলে সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।