আজ ৮ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শুধুমাত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনীই ছিলেন না। আত্মিক বর্ণাঢ্যে তিনি ছিলেন মহীয়সী ও ঐশ্বর্যময়ী নারীÑ বাঙালির সকল লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলনের নেপথ্যের প্রেরণাদাত্রী; বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেপথ্য কারিগর; পরামর্শ দাত্রী, বিচক্ষণ উপদেষ্টা, বিনয়াবনত সারথী, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক।
বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দেয়া এক নীরব সংগঠক। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন আদর্শ বাঙালি নারী। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন তিনি। দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামে নিজেকে জড়িত রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর পুরো রাজনৈতিক জীবনে ছায়ার মতো লেগে থেকে তাঁর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অফুরান প্রেরণার উৎস জুগিয়েছেন। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেছেন। ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন প্রাণপ্রিয় স্বামী বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে এবং এই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য অবদান রেখেছেন। জীবনে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন, এজন্য অনেক কষ্ট-দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বঙ্গমাতাকে।
তিনি সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর মতোই মানুষকে ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর ন্যায় তাঁরও চিন্তাজগত জুড়ে ছিল এদেশের মানুষ। দেশমাতৃকার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন যৌবনের অর্ধেক সময় কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে বন্দি ছিলেন। বেগম মুজিব কারারুদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আন্দোলনেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। একদিকে অত্যন্ত কষ্টের মধ্য দিয়ে সন্তানদের নিয়ে সংসার চালিয়েছেন অন্যদিকে কারারুদ্ধ স্বামীর সামনে সাংসারিক অনটনকে সামনে না নিয়ে এসে দেশের মানুষের পক্ষে অনড় থাকতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস জেলের অভ্যন্তরে কাটাতে হয়েছে। এই সময় আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মী, বিশেষ করে ছাত্রনেতাদের নির্ভরতার কেন্দ্র বা আশ্রয়স্থল ছিলেন বেগম মুজিব। রাজনৈতিক কর্মীদের তিনি মনে-প্রাণে ভালবাসতেন। পরম মমতার বন্ধনে আবদ্ধ করতেন।
বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয়-দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু যখন বারবার পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি জীবনযাপন করছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তাঁর কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাতেন। বিশেষ করে আগরতলা যড়যন্ত্র মামলায় যখন তার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে দলের কিছু কুচক্রী স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন, তখন প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে বেগম মুজিবের দৃঢ়চেতা অবস্থান বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও ছিলেন দৃঢ়চেতা, আপসহীন মানুষ। চরম অনটন, টানাপোড়েন, ভয়-ভীতি কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনিও বঙ্গবন্ধুর ন্যায় বাঙালি জাতির অধিকারের প্রশ্নে অটল, অবিচল, আপসহীন ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, অসীম ধৈর্য্য ও সাহস নিয়ে জীবনে যেকোন পরিস্থিতি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করতেন তিনি। একটার পর একটা ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। বঙ্গমাতা কখনও ভেঙে পড়েননি। যত কষ্টই হোকÑ বঙ্গবন্ধুকে বলেননি যে, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসারের খরচ দাও। মেয়েদের অনেক আকাক্সক্ষা থাকে স্বামীদের কাছ থেকে পাবার। শাড়ি, গহনা, বাড়ি, গাড়ি, কত কিছু! কিন্তু এসব লোভ-লালসা কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বাংলার মাটি ও মানুষের কল্যাণ চিন্তাই ছিল তাঁর চিন্তাজগতের মূল কেন্দ্র। বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে ছিল তার অবিচ্ছেদ্য সংযোগ।
শেখ ফজিলাতুন্নেছার বুদ্ধিদীপ্ত, দূরদর্শী, সাহসী, নিষ্ঠাবান ও ইতিবাচক ভূমিকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগকে সর্বদা সহায়তা করেছে। জনগণের কল্যাণে সমগ্র জীবন তিনি অকাতরে দুঃখবরণ এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার সন্তান শেখ মুজিব ধীরে ধীরে শুধুমাত্র বাঙালি জাতির পিতাই নন, বিশ্ব বরেণ্য রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছিলেন, তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁরই সহধর্মিনী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য এই মহিয়সী নারীকে তাঁর জীবন থেকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবার সুযোগ দিতে পারিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যখন জাতিগত উন্নয়ন বিকাশ ও সমৃদ্ধি অর্জনের সংগ্রামের ধারা অগ্রসরমান ঠিক তখন ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। নরপশুরা সেদিন স্বামী, সন্তান, পুত্রবধূদের সাথে এই মহীয়সী নারী বেগম মুজিবকেও নিমর্মভাবে হত্যা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে ১৫ আগস্টের এতো নিষ্ঠুর ও নির্মম আর কোন রাজনৈতিক ষযড়ন্ত্র বা হত্যাকান্ড খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাঙালির অহংকার এবং নারী সমাজের প্রেরণার উৎস। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন নির্লোভ, ত্যাগী, কষ্ট সহিষ্ণু, প্রত্যয়ী ও দৃঢ়চেতা। তদুপরি তিনি ছিলেন নির্মোহ ও সাধাসিধে গোছের। সর্বংসহা, ধীরস্থির, বুদ্ধিদীপ্ত, মিতভাষী, মিতব্যয়ী, কৌতূহলী, পড়ুয়া স্বভাবের, শ্রুতিধর, ধৈর্যশীল, সাহসী এবং স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগিতাকারিনী। তিনি ছিলেন দানশীল, উদার, অমায়িক, সংবেদনশীল ও সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল। অর্থ, বিত্ত-বৈভব, গাড়ি, বাড়ি, অলঙ্কার, ক্ষমতার প্রতি তার ন্যূনতম আগ্রহ ছিল না।
জন্মদিনে মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের মৃত্যু নেইÑ তারা চিরঞ্জিব; কোটি কোটি বাঙালি সন্তানের অন্তরে বেঁচে থাকবেন। বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ যতদিন থাকবেÑ এই পৃথিবী যতদিন থাকবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েই বেঁচে থাকবেন। আর ইতিহাসের এই নক্ষত্রের গতিপথে সমহিমায় উদ্ভাসিত থাকবেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গমাতাকে নিয়ে লেখা শহীদ শেখ রাসেলের গৃহ শিক্ষক গিতালী দাস গুপ্তা’র একটি পংক্তি দিয়ে শেষ করবোÑ
বাংলার আকাশের দিকে তাকাও
অজস্র তারার মাঝে তাকে দেখবে,
বাংলার মাটির দিকে তাকাও,
দেখ, মা আর মাটি একাকার হয়ে আছে।
প্রকৃতির দিকে তাকাও,
মায়ের হৃদয় স্পর্শ আর গন্ধ খুঁজে পাবে।
আমাদের দিকে তাকাও,
দেখ, সন্তানের অন্তরে তিনি অধিষ্ঠিতা।