* অভাব-অনটন নিয়ে দাম্পত্য কলহ
* বাবা-মা একে অপরকে দোষারোপ করছে
* হত্যার ঘটনা নিয়ে ধ্রুমজালের সৃষ্টি
কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু : সংসারে অভাব-অনটনের কারণে দাম্পত্য কলহ। আর এর জের ধরেই মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে বিলের পানিতে ফেলে দিয়ে ৬ মাস বয়সী যমজ দুই বোন লামিয়া ও সামিয়াকে হত্যা করা হয়েছে।
গত সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার কুকুটিয়া ইউনিয়নের বিবন্দী গ্রামের বিলের পানি থেকে ৬ মাস বয়সী শিশু দু’টির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। পরে গ্রামবাসী মরদেহ বাড়িতে নিয়ে গেলে মা শান্তা আক্তার দুই শিশু সন্তানকে তার বাবা সোহাগ শেখ পানিতে ফেলে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেন।
অপরদিকে বাবা সোহাগ শেখও পাল্টা অভিযোগের সুরে বলেন, মা শান্তা আক্তারই তার যমজ দুই শিশু সন্তানকে পানিতে ফেলে হত্যা করেছে। এই অবস্থায় দুই শিশু সন্তানকে হত্যার সঙ্গে বাবা-মা উভয়েই একে অপরকে দোষারোপ করে বক্তব্য দিচ্ছে। এর ফলে মর্মান্তিক এই হত্যাকান্ডের ঘটনা নিয়ে ধ্রুমজালের সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে এ খবর পেয়ে গত সোমবার রাত ১০টার দিকে বিবন্দী গ্রামে গিয়ে নিহত দুই শিশুর মরদেহ নিজেদের হেফাজতে নেয় পুলিশ। একই সময়ে হত্যার ঘটনায় একে অপরকে দোষারোপ করে বক্তব্য দেওয়ায় সন্দেহের সৃষ্টি হলে মা শান্তা আক্তার ও বাবা সোহাগ শেখকে আটক করে শ্রীনগর থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে রাতভর পৃথক পৃথক কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করলেও দু’জনের কেউই হত্যার দায় স্বীকার না করায় গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই শিশু হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কে এবং কি কারণে তাদের ৬ মাস বয়সী যমজ দুই সন্তানকে হত্যা করেছে তাও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
তবে পুলিশ ও গ্রামবাসী ধারনা করছে, সংসারে অভাব-অনটন নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক কলহের জের ধরেই ক্ষুব্ধ হয়ে দু’জনের মধ্যে যে কোন একজন দুই শিশু সন্তানকে পানিতে ফেলে হত্যা করেছে। এখন ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে একে অপরকে দোষারোপ করছে তারা।
এদিকে শিশু সন্তানদের হত্যার পর বিলের পানি থেকে লাশ উদ্ধারের পর থেকে মা শান্তা আক্তার অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ পরপর কান্নাকাটি করছেন এবং দুই শিশু সন্তানকে তার বাবা সোহাগ পানিতে ফেলে দিয়ে হত্যা করে বলে অভিযোগ করে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, শ্রীনগর উপজেলার বিবন্দী গ্রামের দিনমজুর সোহাগ শেখের সাথে প্রায় ২ বছর আগে উপজেলার বীরতারা ইউনিয়নের মজিদপুর দয়হাটা গ্রামের শাহআলমের মেয়ে শান্তার বিয়ে হয়। প্রায় ৫ মাস আগে শান্তা যমজ কন্যা সন্তান প্রসব করে। সন্তান হওয়ার পর থেকে তাদের মধ্যে প্রায়ই পারিবারিক কলহ লেগে থাকতো। শান্তা সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকলেও বেশ কয়েকদিন আগে সে স্বামীর বাড়িতে যায়। গত সোমবার রাত ৮টার দিকে সোহাগের ঘর থেকে হট্টগোলের শব্দ শুনে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে জানতে পারে বেশ কিছুক্ষণ আগে লামিয়া ও সামিয়াকে পার্শ্ববর্তী পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। এসময় স্থানীয় গ্রামবাসী পুকুরে নেমে লামিয়া ও সামিয়াকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের বাবা সোহাগও ছুটে যায়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক দুই শিশুকে মৃত ঘোষণা করেন।
স্থানীয়রা জানায়, লামিয়া ও সামিয়াকে উদ্ধারের পর তাদের মা শান্তা জানায় পারিবারিক কলহের জের ধরে বাবা সোহাগ শেখ তাদেরকে পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়।
অপরদিকে সোহাগ শেখের দাবি, তার স্ত্রী শান্তা সন্তানদের পানিতে ফেলে দিয়েছে। তবে সোহাগ শেখের বাকপ্রতিবন্ধী ভাই মামুন ইশারায় প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে অভিযোগের আঙ্গুল তোলে ভাবী শান্তার দিকে। এরপরই পুলিশ স্বামী সোহাগ শেখ ও স্ত্রী শান্তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছে।
মা শান্তা আক্তার গত সোমবার সন্ধ্যা রাতে প্রতিবেশীদের জানান, তার মেয়েদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে বাড়ির পাশে বিলের পানি থেকে দুই শিশুকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের শ্রীনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশু দু’টিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
বাবা সোহাগ শেখের স্বজনদের অভিযোগ, সোহাগ বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামের পাশের বাজারে গিয়েছিল। তখন দুই শিশু মা শান্তার কোলে ছিল। শিশু দুটিকে শান্তাই বিলের পানিতে ফেলে হত্যা করেছে।
মা শান্তা আক্তারের স্বজনদেরও পাল্টা অভিযোগ বাবা সোহাগের বিরুদ্ধে। তাদের দাবী, শিশু দুটিকে বাড়ির পাশে বিলের পানিতে ফেলে দিয়ে বাবা সোহাগ বাজারে চলে যায়। যাতে কেউ তাকে সন্দেহ না করতে পারে। হত্যার ঘটনা ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এখন মা শান্তাকে দায়ী করছে সোহাগ। শিশুদের চাচা সাকিব শেখ বলেন, রাত ৮টার দিকে সোহাগের ঘর থেকে চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে শান্তার কাছ থেকে জানতে পারি, সোহাগ বাচ্চাদের ডোবায় ফেলে দিয়েছেন। তখন ঘরে সোহাগকে পাওয়া যায়নি। আমি পুকুরে গিয়ে দেখি, দুই শিশু উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই।
কুকুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল কাইয়ুম বলেন, শিশু দুটিকে বাবা অথবা মা তাদের দু’জনের মধ্যে যে কোনো একজন পানিতে ফেলে দিয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। লাশ উদ্ধারের পর হত্যার ঘটনাটি নিয়ে সোহাগ ও শান্তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। তবে আমরা প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা চালাচ্ছি।
তিনি বলেন, যেহেতু গ্রামের প্রতিবেশীদের কেউই দুই শিশুকে পানিতে ফেলতে না দেখলেও বাবা সোহাগ অথবা মা শান্তা আক্তার-এই দু’জনের যে কোনো একজন তাদের শিশু সন্তানদের পানিতে ফেলে হত্যা করেছে এটা প্রায় নিশ্চিত।
শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক সিনথিয়া নুর জানান, সোমবার রাত সোয়া ৯টার দিকে পানিতে পড়া দুই শিশুকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসে।
জানতে চাইলে শ্রীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নাজমুল হুদা গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে জানান, প্রাথমিক তদন্তে দুই শিশুকে হত্যার সঙ্গে তাদের বাবা-মা জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই সোমবার রাতেই শিশু দুটির বাবা সোহাগ ও মা শান্তা আক্তারকে আটক করা হয়েছে। বর্তমানে তাদের থানা হেফাজতে ১৬১ ধারা মতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে দু’জনের কেউই হত্যার দায় নিচ্ছে না। তারা এ ঘটনার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছে।
ওসি আরও জানান, এ ঘটনায় মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত পরিবার বা স্বজনদের মধ্যে কেউই থানায় কোনো অভিযোগ দাখিল করেনি। শিশুদের পক্ষ থেকে কেউ মামলা না করলে পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা রুজু করবে। এছাড়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বামী-স্ত্রীর কেউই যেহেতু হত্যার কারণ এবং কে শিশুদ্বয়কে পানিতে ফেলে হত্যা করেছে তার স্বীকারোক্তি না দেওয়ায় অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই দম্পতিকে আদালতে প্রেরণ করে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই যমজ শিশু হত্যার রহস্য উদঘাটন হবে এবং হত্যাকারী সনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে বাবা-মা দু’জন মিলে পানিতে ফেলে তাদের যমজ কন্যা শিশুদের হত্যা করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন শ্রীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
ওসি মোঃ নাজমুল হুদা খান আরও জানান, পানিতে ফেলে দেওয়ার ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তি ছিল না। তাই পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে ও স্থানীয় গ্রামবাসীর তদন্তে স্বামী-স্ত্রী দু’জন মিলেই যমজ সন্তানদের পানিতে ফেলে মেরে ফেলার বিষয়টি সামনে আসতে শুরু করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করলেই হত্যার মূল রহস্য উদঘাটন হয়ে যাবে।
শ্রীনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম জানান, শিশু দুটির পানিতে ডুবে মৃত্যুর খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। গ্রামবাসীর ভাষ্য অনুযায়ী, পারিবারিক কলহের জের ধরেই শিশুদের পুকুরে ফেলে মেরে ফেলা হয়েছে।