# ২২ বছরে সাত শতাধিক দূর্ঘটনা, প্রাণহানি ৬ হাজার
# তদন্ত হয় কিন্তু রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না
বিশেষ প্রতিবেদক
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের রাজধানীর সাথে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান রুট শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুট। একসময় মাওয়া কাওড়াকান্দি নৌরুটে শুধু ফেরি চলাচল করতো। পরে ফেরির সাথে যুক্ত হয় ইঞ্জিনচালিত ট্রলার, এরপর লঞ্চ। সর্বশেষ সংযোজন হয় স্পিডবোট। এই রুটের ঘাট পরিবর্তন হয়েছে একাধিকবার। এখন এই রুটের মুন্সীগঞ্জ অংশের নাম শিমুলিয়া এবং মাদারীপুর অংশের ঘাটের নাম বাংলাবাজার। এই শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে কোনো স্পিডবোট চালকের নেই লাইসেন্স, বোট চলাচলের নেই অনুমতি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৯০ এর দশকে এই নৌরুটে ফেরির পাশাপাশি সাধারণ যাত্রীদের পারাপারে বিকল্প বাহন ছিল ট্রলার। পরবর্তী সময়ে আধুনিক বাহন হিসেবে যুক্ত হয় লঞ্চ। ২০০২ সালের দিকে স্পিডবোট জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। সেই সময়ে মাত্র ১৫ থেকে ২০টি বোট চলাচল করতো এই নৌরুটে। দ্রুত সময় পারাপারের কারণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে স্পিডবোট। যাত্রীদের কাছেও চাহিদা বাড়ে এই বাহনটির। জনপ্রিয়তার সাথে সাথে স্পিডবোটের সংখ্যা ও ভাড়ার পরিমাণ বাড়তো পাল্লা দিয়ে। সাথে বাড়তে থাকে স্পিডবোট দূর্ঘটনার মাত্রাও। প্রাণহানি, নিখোঁজ ও পঙ্গুত্বের সংখ্যাও বাড়ে। এই নৌপথ দিয়ে দৈনিক গড়ে ৩০ হাজার মানুষ যাতায়াত করে। যাত্রীদের বড় একটি অংশ পারাপার হয় স্পিডবোটে।
প্রতিবছরই দূর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। গত ২২ বছরে প্রায় সাত শতাধিক ছোট-বড় দূর্ঘটনা ঘটে। প্রাণহানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর। প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়। বেশিরভাগ রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না। কিছু কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। দেখা গেছে, নৌদূর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে, তদন্ত করছে। কিন্তু ফল শূন্য। নৌদূর্ঘটনা থামছে না। আবার ছোট ছোট দূর্ঘটনাগুলো কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি বলেই বড় দূর্ঘটনা ঘটে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের ২০ জুন এমভি ময়ুর-২ এর আঘাতে রানিং বার্ড সদরঘাটে ডুবে যায়। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হলেও গত দশ মাসে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি সম্প্রতি শীতলক্ষ্যায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট লালফিতায় বন্দি। এই দূর্ঘটনার রেশ না কাটতেই গত সোমবার পদ্মা নদীতে বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের ধাক্কায় ২৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। বর্তমানে এই নৌপথে প্রায় চার শতাধিক স্পিডবোট চলাচল করে। কিন্তু অবাক করা বিষয়, এই নৌরুটে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে স্পিডবোট চলাচলের কোনো সরকারি অনুমিত নেই। স্থানীয় প্রশাসনের মৌখিক অনুমতি নিয়েই দিনের পর দিন চলছে স্পিডবোট। একারণে নেই সরকার নির্ধারিত কোনো নীতিমালা। নিবন্ধিত না থাকায় স্পিডবোটের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। তবে উভয় ঘাট মিলিয়ে চার শতাধিকের বেশি রয়েছে বলে ঘাট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, স্বল্প সময়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় বিধায় এটি যাত্রীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি রুট। বিআইডব্লিউটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, এই নৌরুটে নিয়মিত চলাচল করছে ৮৭টি ছোট-বড় লঞ্চ, ১৬টি ফেরি। সরেজমিনে ঘাট ঘুরে জানা গেছে, বোট চালানোয় কোনো প্রশিক্ষণ নেই তাদের। আর চালকদের বেশিরভাগই উঠতি বয়সী তরুণ। বিশেষ করে পদ্মার ঘাট এলাকার এক শ্রেণির বখাটে, মাদকাসক্ত যুবকরাও স্পিডবোট চালক হিসেবে রয়েছে। আর এদের কাছেই বিভিন্ন সময়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। নিয়ন্ত্রণহীন গতির কারণে ঘটছে দূর্ঘটনাও। তাছাড়া প্রতিটি ট্রিপেই ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করে এসব স্পিডবোট। নেই কোনো কর্তৃপক্ষের তদারকি।
এদিকে, এই নৌপথে চলাচলরত ৫০টির মতো স্পিডবোট বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক লাইসেন্স নিয়েছে। যে কয়টির লাইসেন্স আছে, তারও আবার নবায়ন নেই। ফলে চলাচলরত স্পিডবোটগুলোর সব কয়টি অবৈধ। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের বিআইডব্লিউটিএ’র শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ) মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, প্রায় ৫০টি স্পিডবোটের লাইসেন্স নেওয়া। তবে এগুলোর হয়তো নবায়ন নেই। এখানে আমাদের লাইসেন্স দিতে কোনো সমস্যা নেই। আমরা দ্রুত স্পিডবোটগুলো লাইসেন্সসহ চলাচলে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসব।
এদিকে অবৈধভাবে পারাপার ঠেকাতে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া সংলগ্ন পদ্মার শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাটে বাঁশ-রশি-লাল কাপড়ে ব্যারিকেড দিয়েছে পুলিশ। নিষিদ্ধের সময় শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে স্পিডবোট চলাচল বন্ধে এ পদক্ষেপ নিয়েছে মাওয়া নৌ-পুলিশ।
গতকাল বুধবার বিকাল ৫টায় স্পিডবোট ঘাটের প্রবেশমুখে বাঁশ ও নদীর অংশে চারদিকে রশি-লাল কাপড়ে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয় নৌ-পুলিশ। এতে ঘাটে স্পিডবোট ও যাত্রী প্রবেশের সুযোগ থাকছে না। তাছাড়া স্পিডবোট ঘাটে অবস্থান নিয়েছে নৌ-পুলিশের একটি টিম। মাওয়া নৌ-পুলিশের ইনচার্জ সিরাজুল কবির জানান, কঠোর লকডাউন ১৬ মে পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই দিন পর্যন্ত যাতে কোনো ধরনের স্পিডবোট, ট্রলার যাতে চলাচল করতে না পারে সেজন্য রশি, বয়া, লাল কাপড় দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে। ঘাট এলাকা পুরোপুরি লকডাউন করা হয়েছে এবং টহল জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ ডিউটিও চালু থাকবে।
উল্লেখ্য, গত সোমবার সকাল ৬টার দিকে শিমুলিয়া থেকে যাত্রী বোঝাই একটি স্পিডবোট কাঁঠালবাড়ী ঘাটে নোঙর করে রাখা একটি বাল্কহেডের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে স্পিডবোটের ২৬ যাত্রী নিহত হয়।